গর্ভাবস্থায় নিম্ন রক্তচাপ খুব সাধারণ সমস্যা। এতে ভয় পাবার কোনো কারণ নেই। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এটি ঝুঁকিপূর্ণ নয়। তাছাড়া সাধারণত প্রসবের পর পরই রক্তচাপ গর্ভাবস্থার আগের অবস্থায় ফিরে যায়। তবে ব্যতিক্রম কিছু ক্ষেত্রে রক্তচাপ খুব বেশি কমে গেলে তা বিপজ্জনক হতে পারে।

গর্ভাবস্থায় রক্তচাপ কমে যাওয়ার কারণ কী?
মানুষের হৃৎপিণ্ডের সংকোচন ও প্রসারণের কারণে ধমনী ও শিরা-উপশিরার মাধ্যমে সমগ্র শরীরে রক্ত প্রবাহিত হয়। হৃৎপিণ্ডের সংকোচন ও প্রসারণের কারণেই রক্ত ধমনীর প্রাচীরে চাপ প্রয়োগ করে। এই চাপ দিনের যেকোনো সময় বাড়তে পারে বা কমতে পারে। মানুষের অনুভূতি, উত্তেজনা, দুশ্চিন্তা এমনকি আবেগ থেকেও এর হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটতে পারে। গর্ভাবস্থায় গর্ভবতী মায়েরা যতবার ডাক্তারের কাছে চেকআপের জন্য যেয়ে থাকেন ততবারই ডাক্তাররা তাদের রক্তচাপ পরীক্ষা করে থাকেন। রক্তচাপের মাত্রা থেকেও গর্ভবতী মা ও গর্ভস্থ শিশু কেমন আছে সে ব্যাপারে ধারণা লাভ করা যায়।

যদি মায়ের প্রিক্ল্যাম্পসিয়া হয়ে থাকে তাও ব্লাড প্রেশারের মাধ্যমে বোঝা যায়। প্রিক্ল্যাম্পসিয়া এমন একটি রোগ যাতে গর্ভাবস্থায় মায়ের উচ্চ রক্তচাপ থাকে আবার প্রস্রাবের সাথে প্রোটিন নির্গত হয়।
এছাড়াও নিম্ন রক্তচাপের কারণ হতে পারে এক্টোপিক প্রেগন্যান্সি যাতে ভ্রূণ ইউটেরাসে অবস্থান না নিয়ে ইউটেরাসের বাইরের কোন স্থানে বেড়ে ওঠে এবং যা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। গর্ভাবস্থায় শরীরে যেসকল পরিবর্তন আসে সেগুলোর কারণেও অনেক সময় ব্লাড প্রেশার কমে যেতে পারে। শরীরে অতিরিক্ত ওজন তথা ভ্রূণ বহনের কারণে মায়ের শ্বাস-প্রশ্বাস দ্রুততর হয়। এর কারণেও নিম্ন রক্তচাপ দেখা দিতে পারে। যেসকল কারণে নিম্ন রক্তচাপ দেখা দেয় সেগুলো হলো-
- পানিশূন্যতা
- রক্তশূন্যতা
- রক্তস্রাব
- অধিক সময় ধরে বিছানায় বিশ্রাম নেয়া
- হার্টের সমস্যা
- পুষ্টিহীনতা
- এন্ডোক্রাইন ডিজঅর্ডার ইত্যাদি

লো ব্লাড প্রেশার আসলে কোনটি?
সাধারণত হার্টের সিস্টোলিক চাপ ১২০ মিমি পারদচাপের কম (উচ্চমাত্রা) ও ডায়াস্টোলিক চাপ ৮০মিমি (নিম্নমাত্রা) পারদচাপের বেশি হলে একে নরমাল বা স্বাভাবিক রক্তচাপ ধরা হয়। কোনোভাবে এই চাপ ৯০-৬০ তে নেমে আসলে বা এর চেয়ে কম হলে একে নিম্ন রক্তচাপ বা লো ব্লাড প্রেশার ধরা হয়।
গর্ভাবস্থায় নিম্ন রক্তচাপ কি ঝুঁকিপূর্ণ?
রক্তচাপ খুব বেশি কমে না গেলে তা গর্ভাবস্থার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ নয়। যদি নিম্ন রক্তচাপের কারণে নির্দিষ্ট কিছু লক্ষণ প্রকট হারে দেখা দেয় তবে তা অবশ্যই চিন্তার কারণ। কারণ অতি নিম্ন রক্তচাপ থেকে হতে পারে অংগহানি, শক ইত্যাদি।
গর্ভাবস্থায় নিম্ন রক্তচাপের কারণে কি গর্ভস্থ শিশুর কোন ক্ষতি হবার সম্ভাবনা আছে?
রক্তচাপ সামান্য কম হলে তা গর্ভস্থ শিশুর জন্য ঝুঁকিপূর্ণ নয়। তবে রক্তচাপ অনেক কম হলে তা থেকে কম ওজনের শিশুর জন্মগ্রহণ এমনকি তৃতীয় ট্রাইমিস্টারে ভ্রূণের মৃত্যু হবারও সম্ভাবনা থাকে।
লক্ষণ
নিম্নোক্ত লক্ষণগুলো দেখলে বুঝতে হবে গর্ভবতী মায়ের নিম্ন রক্তচাপ থাকতে পারে।
- মাথা ঘোরা। বিশেষ করে শোয়া বা বসা অবস্থান থেকে হঠাৎ দাড়ালে মাথা ঘোরে ওঠা ও শরীরের ভারসাম্য হারিয়ে ফেলা
- হঠাৎ অবচেতন হয়ে যাওয়া বা সাময়িক সময়ের জন্য অজ্ঞান হয়ে যাওয়া
- বমিভাব
- প্রচন্ড ক্লান্তি
- চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসা বা চোখ খোলা রাখতে কষ্ট হওয়া
- অস্বাভাবিক তৃষ্ণা
- জরাজীর্ণ ও প্রাণহীন ত্বক
- শ্বাস-প্রশ্বাস দ্রুততর হওয়া
গর্ভাবস্থায় নিম্ন রক্তচাপ নিরীক্ষণে কোন ঝুঁকি আছে কি?
সাধারণ তথা ম্যানুয়াল মেশিন দিয়েই রক্তচাপ মাপা যায় যা গর্ভাবস্থায় মোটেও ঝুঁকিপূর্ণ নয়।
চিকিৎসা ও করণীয়
সাধারণত নিম্ন রক্তচাপের কোনো ওষুধ নেই। অতিমাত্রায় কম না হলে ডাক্তার কোনো ওষুধ গ্রহণের পরামর্শ দেন না। তবে এ থেকে অন্য কোনো রোগ হয়ে থাকলে সে রোগের ওষুধ দেয়া হয়ে থাকে। সাধারণত তৃতীয় ট্রাইমিস্টারেই এই রক্তচাপ ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। তবে কোনো ওষুধ না থাকলেও রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে গর্ভবতী মাকেই হতে হবে সতর্ক ও নিজের প্রতি যত্নশীল। নিম্নের বিষয়গুলো গর্ভাবস্থায় মনে রাখা ও মেনে চলা জরুরি।
- প্রচুর পানি খেতে হবে। প্রয়োজনে শরবত বা স্যালাইন বা জুস্ খাওয়া যেতে পারে।

- শোয়া অবস্থান থেকে হঠাৎ বসা বা উঠে দাঁড়ানো উচিত নয়। ধীরে ধীরে ওঠা এমনকি প্রতিবার নড়াচড়া ও কাত ঘোরার সময়ও ধীরস্থিরতা অবলম্বন করা উচিত।
- দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে থাকা উচিত নয়। প্রয়োজনে কিছুক্ষণ পর পর বসে বিশ্রাম নিয়ে আবার দাঁড়িয়ে কাজ করা নিরাপদ।
- একবারে অতিরিক্ত পরিমান না খেয়ে অল্প অল্প করে ঘন ঘন খাওয়া উচিত। এতে অস্বস্তি অনেক কমে যায়। আবার অনেকক্ষণ না খেয়ে থাকাও উচিত নয়, এতে রক্তচাপ কমে যায়।
- অতিরিক্ত গরম পানি দিয়ে গোসল করা উচিত নয়। অতিরিক্ত গরমে বাইরে বের হওয়া বা ক্লান্তিকর কাজ করা উচিত নয়। এতে রক্তচাপ কমে গিয়ে মাথা ঘোরা সহ অন্যান্য অসুস্থতা দেখা দিতে পারে।
- আঁটসাঁট কাপড় না পরে ঢিলেঢালা পোশাক পরিধান করতে হবে।
- শাক সবজির পাশাপাশি গরুর মাংস, গরুর দুধ বা দুগ্ধজাত খাবার যেমন চিজ ইত্যাদি খাবার তালিকায় রাখতে হবে।

গর্ভাবস্থায় নিম্ন রক্তচাপ থাকলে প্রসবের পরেও কি মায়ের নিম্ন রক্তচাপ থাকে?
না। গর্ভাবস্থায় নিম্ন রক্তচাপ থাকলে প্রসবের পরে তা স্বাভাবিক মাত্রায় ফিরে আসে। তাই এতে ভয়ের কিছু নেই। বরং গর্ভাবস্থায় নিম্ন রক্তচাপ থাকাটা অনেকে ইতিবাচক মনে করেন কারণ এতে রক্তচাপ উচ্চমাত্রার হবার সম্ভাবনা কমে যায় যা ঝুঁকিপূর্ণ।
Comments 0