মায়ের গর্ভে ভ্রূণ শিশু বিভিন্ন অবস্থানে থাকতে পারে। এই অবস্থানের উপর গর্ভাবস্থা ও প্রসবের অনেক কিছুই নির্ভর করে। গর্ভাবস্থার প্রথম দিকে ভ্রূণের আকার ছোট থাকে বলে গর্ভের অভ্যন্তরে ভ্রূণশিশু যেভাবে খুশি নড়াচড়া করতে পারে। ফলে মা কখনও লাথি কখনও ডিগবাজি কখনও বা ঘূর্ণির মত নড়াচড়া অনুভব করেন।

কিন্তু গর্ভাবস্থার শেষের দিকে ভ্রূণ শিশু বেশ বড় হয়ে যায় বলে ইউটেরাসে জায়গাও কমে আসে। প্রসবের তারিখ যত এগিয়ে আসে শিশুটিও তত ধীরে ধীরে একটি নির্দিষ্ট অবস্থান গ্রহণ করে যা অত্যন্ত গুরূত্মপূর্ণ। ডাক্তাররাও গর্ভাবস্থার শেষ সময়ে শিশুর অবস্থান ঘন ঘন পরীক্ষা করেন। এর উপর নির্ভর করে মায়ের নরমাল ডেলিভারি হবে নাকি সি-সেকশন।
সাধারণত মায়ের গর্ভে শিশুর অবস্থান ৪ ধরণের হতে পারে।
- এন্টেরিওর পজিশন
- পোস্টেরিওর পজিশন
- ট্রান্সভার্স লাই পজিশন
- ব্রীচ পজিশন
তবে সব অবস্থান নিরাপদ নয়। আর গর্ভে শিশুর এই পজিশন মায়ের পেলভিসের আকার সহ অনেক কিছুর উপর নির্ভর করে। তাই কোন অবস্থানটি নিরাপদ বা শিশু ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানে থাকলে একে প্রসবের আগেই সঠিক অবস্থানে আনতে মায়ের কি করা উচিৎ সে সম্পর্কে জেনে রাখা ভাল।
এন্টেরিওর পজিশন

এ অবস্থানে শিশুর মাথা নিচের দিকে থাকে, কিন্তু এর মুখ থাকে মায়ের পিছন দিকে বা পঠের দিকে। এর থুঁতনি একদম বুকের সাথে লেগে থাকে। আর মাথাটাও সঠিক সময়ে মায়ের পেলভিসে প্রবেশ করার জন্য প্রস্তুত থাকে। শিশুটি তার ঘাড় ও মাথা নাড়াতে পারে। এ অবস্থানকে অক্সিপিটো- এন্টেরিওর (occipito-anterior) বা সেফালিক প্রেজেন্টেশন (cephalic presentation) বলা হয়।
প্রসবের শুরুতে মাথার শীর্ষভাগের সরু অংশটি সারভিক্সে চাপ দিতে শুরু করে যা সারভিক্সের মুখ খুলতে সহায়তা করে এবং নরমাল ডেলিভারি হতে সাহায্য করে। বেশিরভাগ শিশুই ৩৩ থেকে ৩৬ সপ্তাহের মধ্যেই এরকম মাথা নিচে ও পশ্চাৎভাগ উপরে এই পজিশনে চলে আসে আর এই পজিশনই সবচেয়ে নিরাপদ।
পোস্টেরিওর পজিশন

পোস্টেরিওর অবস্থানে শিশুর মাথা নিচের দিকে এবং পশ্চাৎ ভাগ উপরের দিকে থাকে কিন্তু এর মুখ থাকে মায়ের সাম্নের দিকে বা পেটের দিকে। একে সাধারণত অক্সিপিটো-পোস্টেরিওর পজিশন (occipito-posterior (OP) position) বলা হয়। প্রসবের শুরুর দিকে প্রায় এক দশমাংশ বা এক তৃতীয়াংশ ক্ষেত্রে শিশু এরকম পজিশনে পাওয়া যায়। আবার এদের অধিকাংশই জন্ম নেয়ার আগ মুহূর্তে হঠাৎ নিজে নিজেই ঘুরে গিয়ে এন্টেরিওর পজিশনে অবস্থান নেয়।
তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে ভ্রূণ শেষ মূহুর্তেও একই অবস্থানে থাকে। শিশু এই পজিশনে থাকলে বাচ্চা জন্ম নিতে বেশি সময় লাগে আবার কোমরেও প্রচণ্ড ব্যাথা হতে থাকে। ফলে অনেকসময় এপিডুর্যাল এনেস্থেশিয়া দিয়ে ব্যাথার অনুভূতি দূরিভূত করার প্রয়োজন হতে পারে।
ব্রিচ পজিশন

ব্রীচ পজিশনে থাকা শিশুর পশ্চাৎভাগ কিংবা পা নিচের দিকে থাকে এবং মাথা উপরের দিকে থাকে। তবে ব্রীচ পজিশনেরও আবার ৩ টি প্রকারভেদ আছে।
সম্পূর্ণ বা কমপ্লিট ব্রিচ
এক্ষেত্রে শিশুর পশ্চাৎভাগ মায়ের সারভিক্স তথা জন্মনালীর দিকে থাকে। এ অবস্থানে শিশুর পা হাঁটুর দিকে ভাঁজ হয়ে থাকে এবং পায়ের পাতা পশ্চাৎ ভাগের সাথে লেগে থাকে।
ফ্র্যাংক ব্রিচ
এক্ষেত্রেও শিশুর পশ্চাৎ ভাগ মায়ের সারভিক্সের দিকে তথা জন্মনালীর দিকে থাকে। কিন্তু এদের পা হাঁটুর দিকে ভাঁজ হয়ে থাকে না। বরং পা দুটো কোমরে একবার ভাঁজ হয়ে সোজা উপরে মাথার দিকে ছড়ানো থাকে, অর্থ্যাৎ পায়ের পাতা কপালের সাথে লাগানো থাকে বা মাথার কাছাকাছি থাকে।
ফুটলিং ব্রিচ
এক্ষেত্রে শিশুর একটি বা উভয় পা-ই নিচের দিকে তথা সারভিক্সের দিকে থাকে। ব্রিচ পজিশন নরমাল ডেলিভারির জন্য আদর্শ নয়। যদিও শিশু এ পজিশনে থাকলেও সারভিক্সে সামান্য কাটার মাধ্যমে নরমাল ডেলিভারি সম্ভব, তবুও এতে শিশুর জন্মগত বিভিন্ন সমস্যা হবার ঝুঁকি থেকে যায়। ব্রীচ পজিশনে থাকা শিশুর ক্ষেত্রে প্রসবের সময় জন্মনালী দিয়ে শিশুর পুরো শরীর বের হবার পর মাথা বের হয় যা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে দেয়। এমনকি এ অবস্থায় আম্বিলিক্যাল কর্ড তথা যে নালী দ্বারা শিশু মায়ের শরীরের সাথে সংযুক্ত থাকে সেটি শিশুর গলায় পেচিয়ে যেতে পারে, যাতে শিশুর শ্বাসরোধ হওয়া সহ নানা ঝুঁকি এমনকি মৃত্যুও ঘটাতে পারে।
তাই গর্ভাবস্থার শেষের দিকে শিশুর এমন পজিশন দেখতে পেলে ডাক্তাররা শিশুর পজিশন নিরাপদ অবস্থানে আনার জন্য মাকে কিছু পরামর্শ দিয়ে থাকেন। এমন একটি পদ্ধতির নাম হল এক্সটার্নাল সিফালিক ভার্সন যা ৫০ভাগ ক্ষেত্রে ব্রীচ শিশুর পজিশন স্বাভাবিক করতে সক্ষম হয়। এ পদ্ধতিতে মায়ের পেটে চাপ প্রয়োগ করা হয় যেন চাপের ফলে শিশুটি সঠিক পজিশনে আসে। চাপ প্রয়োগের সময় শিশুটির হার্টবিট অনবরত পরীক্ষা করা হয়। কোন্রকম সমস্যা দেখা দিলেই চাপ প্রয়োগ বন্ধ করা হয়। এরপরেও শিশুর পজিশন ব্রীচ থাকলে সিজারিয়ান ডেলিভারি করার প্রয়োজন হতে পারে।
ট্রান্সভার্স লাই পজিশন

এক্ষেত্রে শিশুটি ইউটেরাসে বাম থেকে ডানে অবস্থান করে। সচরাচর এমনটি দেখা না গেলেও প্রসবকালে শিশু এমন পজিশনে থাকলে নরমাল ডেলিভারি ঝুঁকিপূর্ণ হয় বলে সিজার করানো হয়ে থাকে। কারণ অনেক সময় এমন পজিশনে নরমাল ডেলিভারি করাতে গেলে দেখা যায় আম্বিলিক্যাল কর্ড শিশুর আগেই সারভিক্স দিয়ে বেরিয়ে আসে যখন পানি ভাঙা শুরু হয়। আর এটি খুব বিপজ্জনক পরিস্থিতি যা এড়াতে সিজারিয়ান ডেলিভারি করানো হয়।
Comments 0